বিজ্ঞাপণের জন্য যোগাযোগ করুন- 01966555312

আহতরা বিনা মূল্যে চিকিৎসা পাবেন, কর্মসংস্থানও হবে, সচিবালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত

শরীয়তপুরটাইমস্ অনলাইন ডেস্ক:
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের সুচিকিৎসার পাশাপাশি পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। আহত ব্যক্তিরা দেশের সব সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে সারা জীবন বিনা মূল্যে চিকিৎসা পাবেন। চিকিৎসায় তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন। আর কারও যদি দেশে চিকিৎসা সম্ভব না হয় এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্য বিজ্ঞানসম্মত সুপারিশ করা হয়, তাহলে সেই ব্যবস্থা করা হবে।

আজ বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় উপদেষ্টা ও একজন বিশেষ সহকারী। বৈঠক শেষে সরকারের পক্ষ থেকে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরা হয়। সিদ্ধান্তগুলো সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান। তিনি এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য ছিলেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া ছয় উপদেষ্টা হলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম।

এর আগে গতকাল বুধবার আহত ব্যক্তিদের দেখতে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সবার সঙ্গে দেখা করেননি অভিযোগ করে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় তাঁর পথ আটকে বিক্ষোভ করেন আহত ব্যক্তিরা। পরে তাঁরা রাস্তায় নামেন। একপর্যায়ে পঙ্গু হাসপাতাল ও পাশের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি ওই সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। তাঁদের কারও এক পা নেই, কেউ হুইলচেয়ারে, আবার কারও চোখে ব্যান্ডেজ ছিল। তাঁরা একপর্যায়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দেন। পরে হাসপাতালে ফিরে যেতে চার উপদেষ্টাকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার শর্ত দেন। অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টা ও একজন বিশেষ সহকারী গভীর রাতে সেখানে যান। তাঁদের কাছ থেকে দাবি পূরণের আশ্বাস পাওয়ার পর আহত ব্যক্তিরা রাত সোয়া তিনটার দিকে হাসপাতালে ফিরে যান।

তারই ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে গৃহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা ও করণীয় নির্ধারণে আজ বেলা দুইটায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এই সভার আয়োজন করা হয়।

সভায় বেশ কিছুসংখ্যক আহত ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ এসেছিলেন ক্রাচে ভর দিয়ে। কারও চোখে ব্যান্ডেজ বা হাতে লাগানো নানা যন্ত্র। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাঁরা নানা ক্ষত নিয়ে এসেছেন। তাঁদের কেউ কেউ সরাসরি হাসপাতাল থেকে এসেছেন।

সভা শুরু হওয়ার আগে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। পঙ্গু হাসপাতাল ও চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিদের বাইরে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া আহত ব্যক্তিরাও বৈঠকে যোগ দেন। মূলত এ নিয়েই ক্ষুব্ধ হন পঙ্গু হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এলাকায় বিক্ষোভ করা আহত ব্যক্তিরা। একপর্যায়ে এক পক্ষ সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে বাইরে যায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম তাঁদের বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন।

পরে ছয় উপদেষ্টা ও বিশেষ সহকারীর সঙ্গে বৈঠক করেন আহত ব্যক্তিরা। এ সময় তাঁরা বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। পরে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্তগুলো জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক সায়েদুর রহমান।

যেসব সিদ্ধান্ত হলো:

প্রত্যেক আহত ব্যক্তির জন্য পরিচয়পত্র থাকবে, যেটি তাঁর সুবিধা নিশ্চিত করবে। আহত ব্যক্তিরা দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সারা জীবন বিনা মূল্যে চিকিৎসা পাবেন। তাঁদের জন্য সারা দেশের সব সরকারি হাসপাতালে সুনির্দিষ্ট শয্যা থাকবে। ঢাকার হাসপাতালগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে, যাতে দেখা যাবে কোন হাসপাতালে কয়টি শয্যা খালি আছে।

যেসব বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের চুক্তি হবে, সেসব প্রতিষ্ঠানেও বিনা মূল্যে চিকিৎসা অথবা চিকিৎসা ব্যয়ের আংশিক সরকারের পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে চিকিৎসার জন্য আহত ব্যক্তিরা যে পরিমাণ টাকা খরচ করেছেন, যাচাই করে সেগুলো ফেরত দেওয়া হবে।

আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, সেগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে। এই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের সম্মানের সঙ্গে পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।

যাঁরা পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করেছেন, তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমবেদনা এবং সহানুভূতি জানিয়ে অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সামর্থ্যের সঙ্গে মিলিয়ে প্রশিক্ষিত করে আহত ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।

এ ছাড়া যাঁরা পঙ্গু হয়ে গেছেন, তাঁদের প্রয়োজনীয় ফিজিওথেরাপি অথবা কোনো যন্ত্র লাগানোর প্রয়োজন হলে তা লাগানো হবে। প্রয়োজনে রোবোটিক চিকিৎসা এবং অত্যাধুনিক যন্ত্র প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করার কথাও আলোচনায় এসেছে। আর টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ট্রমার মধ্যে পড়া আহত ব্যক্তিদের মানসিক সহায়তার আওতায় আনা হবে। আহত ব্যক্তিদের জন্য একটি সহায়তা কেন্দ্র (সাপোর্ট সেন্টার) থাকবে এবং সেখান থেকে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। কোনো কোনোটি হয়তো তিন দিন, কোনো কোনোটি পাঁচ দিন, কোনো কোনোটি ১৫ দিনের মধ্যে করা হবে। ডিসেম্বরের মধ্যেই সব কটি দৃশ্যমান হবে। যেগুলো স্বল্পমেয়াদি, সেগুলো দ্রুততার সঙ্গে হবে; যেগুলো দীর্ঘমেয়াদি, সেগুলো দীর্ঘ সময় ধরে চলবে। এসব বিষয়ে কোনো গাফিলতি একেবারেই সহ্য করা হবে না। এসব সিদ্ধান্ত আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিত আকারে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান তিনি। তবে আহত ব্যক্তিদের কেউ কেউ তখনই লিখিতভাবে এসব জানানোর দাবি করতে থাকেন।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন যা করছে..

গত ১২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। আন্দোলনে শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও কর্মসংস্থান, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবার মতো কাজের জন্য এই ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছিল। শহীদ পরিবারকে পাঁচ লাখ ও আহতদের এক লাখ টাকা করে অনুদান দিচ্ছে এই ফাউন্ডেশন। এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক শহীদ পরিবার এবং পাঁচ শতাধিক আহত ব্যক্তিকে গড়ে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক এই সহায়তা কার্যক্রম শেষ বলে আশা করছেন ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন সারজিস আলম। আর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন আন্দোলনে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ।

জরুরি আর্থিক সহায়তা শুরু করার জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর এই ফাউন্ডেশনে ১০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তিনটি উইংয়ে কাজ করছে। একটি উইং ‘শহীদ পরিবারের পাশে বাংলাদেশ’ শিরোনামে শহীদ পরিবারকে সহায়তার কাজ করছে, দ্বিতীয়টি কাজ করছে আহত ব্যক্তিদের নিয়ে আর আরেকটি জরুরি বা কুইক রেসপন্স টিম।

ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোলাবরেট করছি। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে নতুন একটা সেল খোলা হয়েছে। সেটার সঙ্গেও আমাদের একটা কোলাবরেশন আছে। সেলের পক্ষ থেকে আহত ও শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন, গুরুতর আহত ব্যক্তিদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানোর ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।’

সারজিস আলম বলেন, তাঁদের জায়গা থেকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা অবশ্যই আছে। প্রত্যেক শহীদ পরিবার ও গুরুতর আহত ব্যক্তিদের পরিবারের যেকোনো একজনের চাকরির ব্যবস্থা করার চিন্তা আছে। যাঁরা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বা অঙ্গ হারিয়েছেন, সেই অঙ্গ প্রতিস্থাপনে কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না, সেই দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ব্যবস্থা করারও চিন্তা আছে। এ ছাড়া সম্মানী ভাতার ব্যবস্থা করার বিষয়েও আলোচনা চলছে।

Post a Comment

Thnaks For Comment

Previous Post Next Post