আল জাজিরাকে মুহাম্মদ ইউনূস:
- কেবল নির্বাচন করেই নতুন বাংলাদেশ আসবে না, আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না
- ট্রাম্পের সঙ্গে আলাপ হয়নি, ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা নেই
- শেখ হাসিনা নিজেকে প্রধানমন্ত্রী বা অনেক কিছু বলতে পারেন, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৯) ফাঁকে আল–জাজিরাকে এই সাক্ষাৎকার দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: আল–জাজিরার ভিডিও থেকে নেওয়া |
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কতদিন হতে পারে সেই বিষয়ে এই প্রথম ধারণা দিলেন এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি জানালেন তার সরকারের মেয়াদ ‘চার বছরের কম’ হবে। তবে এটা ‘আরও কম হতে পারেও’ বলে আল জাজিরাকে জানিয়েছেন তিনি।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকার। আমরা স্থায়ী সরকার নই। নিয়মিত সরকার পাঁচ বছরের হয়। নতুন সংবিধানে সরকারের মেয়াদ সম্ভবত চার বছর হতে পারে। কারণ, মানুষ সরকারের মেয়াদ কম চায়। সুতরাং এটা (অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ) চার বছরের কম হওয়া উচিত, এটা নিশ্চিত। এটা আরও কম হতে পারে। নির্ভর করছে মানুষ কী চায়, রাজনৈতিক দলগুলো কী চায় তার ওপরে।’
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়সীমা কী হতে পারে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের সঠিক সময় কখন, তার ভাবনা কি, এই প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, ‘আমার মাথায় এমন কিছু নেই।’
সম্প্রতি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৯) ফাঁকে আল জাজিরাকে এই সাক্ষাৎকার দেন মুহাম্মদ ইউনূস।
১৭ নভেম্বর রোববার প্রায় ২৮ মিনিটের এই ভিডিও সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করে আল জাজিরা। সাক্ষাৎকারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের সংকট থেকে বাংলাদেশে সংস্কারপ্রক্রিয়া, নির্বাচন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রসঙ্গও এসেছে।
সরকারের মেয়াদ ও সংস্কার
আল জাজিরার সঞ্চালক নিক ক্লার্কের প্রশ্নঃ নির্বাচন আয়োজন করতে প্রাথমিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল; সেই মেয়াদ বাড়ানো হবে বলে আলোচনা চলছে। বাস্তবতা কী?
জবাবে ইউনূস বলেন, ‘না, কেউ এটাকে সংক্ষিপ্ত সময় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে- এমনটা কখনো হয়নি। রাষ্ট্র সংস্কারকেই মূল দাবি বলা হচ্ছিল, কারণ ছাত্র আন্দোলনই হয়েছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। কেবল নির্বাচন করেই নতুন বাংলাদেশ আসবে না।
‘নির্বাচন আয়োজনের মানে রাজনীতির মাঠে পুরনো পদ্ধতির কেবলই পুনরাবৃত্তি। আমরা এসব থেকে পরিত্রাণ চাই। গোটা দেশের মানুষ এটাই চেয়েছিল নতুন কিছু, পুরাতনের চেয়ে ভিন্ন কিছু। তার মানে অনেক কিছু।’
এই প্রসঙ্গে তিনি বিচার ব্যবস্থা, পুলিশি ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন সংস্কারের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সংবিধানের সংস্কার। ... সে লক্ষ্যেই আমরা কমিশন গঠন করেছি।’
তখন আল জাজিরা প্রশ্ন, ‘জনগণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি নির্বাচন চায় বিষয়টা কি তেমন নয়? সংস্কার তো সরকারের ওপর নির্ভর করে।’
জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা আমাদের ওপর নির্ভর করে না। এটা তাদের (জনগণের) ব্যাপার। আমরা সব সময় বলি, আমরা আপনাদের সঙ্গে পরামর্শ করছি। আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। আপনারা যদি বলেন- এগিয়ে যান, নির্বাচন করুন, সংস্কারের কথা ভুলে যান, আমরা নির্বাচনই করব।
‘আপনি বললেন ওহ, না, এটা (সংস্কার) খুব গুরুত্বপূর্ণ; কারণ অন্য কোনো সরকার এটা (সংস্কার) করতে পারে না। পুরো ইতিহাসে আপনারাই একমাত্র ভাগ্যবান সরকার যে আপনি এই কাজটি করতে পারেন সব রাজনৈতিক দল একমত হলেই হয়ে যাবে। আমরা সংস্কার করছি, তারপর নির্বাচনের আয়োজন করব।’
তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি চার বছর থাকছেন কিনা, এমন প্রশ্নে মুহাম্মদ ইউনূসের জবাব, ‘আমি তা বলিনি যে চার বছর। আমি বলেছি, এটা সর্বোচ্চ মেয়াদ হতে পারে। তবে আমাদের উদ্দেশ্য তা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মানুষ নতুন কিছু চায়। পুরো সরকারব্যবস্থা সংস্কার হবে। সেখানে সব ক্ষেত্রে সংস্কার হবে।’ বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দুটো প্রক্রিয়া সমান্তরাল চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সংস্কারের প্রস্তুতি।’
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক
সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রসঙ্গ আসে। উপস্থাপকের প্রশ্ন, ট্রাম্পের সঙ্গে তার (ইউনূস) টেনশন (উত্তেজনা) থাকা ও তা কিভাবে মোকাবিলা করবেন।
জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ট্রাম্পের সঙ্গে অতীতে কখনো আমার আলাপ-আলোচনা হয়নি। তাই ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই। আর আপনি যদি রিপাবলিকান পার্টির কথা বলেন, তাহলে বলব, আমার ডেমোক্রেটিক পার্টিতে বন্ধু আছে, রিপাবলিকান পার্টিতে বন্ধু রয়েছে। হাউজই (অ্যামেরিকার কংগ্রেস) আমার জন্য কংগ্রেসনাল স্বর্ণপদকের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এ বিষয়ে তারা শতভাগ একমত হয়েছিলেন। আমাকে এ মেডেল দেয়া নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি।
‘ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারণে হঠাৎ করে কোনো নেতিবাচক কিছুর উদ্ভব হবে এমন শঙ্কা আমি দেখছি না। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এমন নয়, যা প্রেসিডেন্ট কে, তার ওপর নির্ভর করে। দেশটির এই নীতির একটি স্থিতিশীল অংশ আছে।’
আবার প্রশ্ন করা হয়, ‘তাহলে আপনি কি মনে করেন না যে তিনি (ট্রাম্প) এই অঞ্চলের ব্যাপারে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেন?’
উত্তরে ইউনূস বলেন, ‘আমি তেমনটা মনে করি না। একেবারেই না।’
শেখ হাসিনা প্রসঙ্গ
শিক্ষার্থীজনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার প্রসঙ্গও এসেছে সাক্ষাৎকারে।
এক প্রশ্নে ইউনূস বলেন, ইউনূস বলেন, ‘তিনি বিবৃতি দিচ্ছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন- দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলায় আমরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছি। ... তাকে (শেখ হাসিনা) আশ্রয় দিচ্ছে, ঠিক আছে। কিন্তু এমনটা হতে থাকলে তাদের (ভারত) কাছে আবার অভিযোগ করা হবে।
‘আপনাদের (ভারত) কাছেই অভিযোগ করতে হবে যে আপনি এমন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন, যা আমাদের জন্য খারাপ। সুতরাং আমাদের উচিত ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণভাবে এর সমাধান করা।’
১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসে আওয়ামী লীগের এক বিবৃতিতে শেখ হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই বিষয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) নিজেকে অনেক কিছু বলতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এমনকি ভারতও তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছে। আশ্রয়দাতাও তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কিছু বলছে না।’
শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা, সে প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া চলছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তার প্রত্যাবর্তন চাওয়া হবে।’
আল জাজিরার প্রশ্ন, ‘শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল। বাইডেন প্রশাসন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?’
তখন প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনি বাংলাদেশে অবস্থান করলে এমনটা ভাবতে আপনাকে পাগলাটে হতে হবে। শিক্ষার্থীরা রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। যখন মব (উন্মত্ত জনতা) সবদিক থেকে তার (শেখ হাসিনা) বাসার দিকে যাচ্ছিল, তখন তার পরিবারই তাকে পালাতে বলেছে। কারণ, অন্যথায়, মব পুরো বাড়ি দখল করবে।...এই পরিস্থিতিতে দেশ থেকে বের হতে সহায়তার জন্য তিনি সেনাবাহিনীকে ডেকেছিলেন। আর সেনাবাহিনী তাকে দেশ থেকে বের হতে, ভারতে চলে যেতে সহায়তা করেছিল। এভাবেই বিষয়টি ঘটেছিল।...এটা ছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। আর তাতে দেশের সব মানুষ যোগ দিয়েছিল।’
উপস্থাপকের প্রশ্ন, ‘ঘটনা যখন ঘটল, তা কি আপনাকে অবাক করেছিল? কিংবা আপনি কি ধারণা করতে পেরেছিলেন যে এমন কিছু ঘটবে?’
এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘প্রথমত আমি তখন দেশে ছিলাম না। তাই ঘণ্টায় ঘণ্টায় কী ঘটছিল, তা আমি জানতে পারছিলাম না। গণমাধ্যমে যা আসছিল, আমি শুধু তাই জানতে পারছিলাম। আমি চূড়ান্ত পরিনতি জানতে পেরেছিলাম।...কারণ আমাকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমাকে ফোন করে বলা হয়েছিল, আমরা আপনাকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাই। এই পরিস্থিতিতে দেশে তিন দিন সরকার ছিল না। কারণ, আমি দেশে ছিলাম না। দেশে আসার পর আমি শপথ গ্রহণ করি। এভাবে সরকার গঠিত হয়। সুতরাং তখন এই অনিশ্চয়তা, অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন ঘটনা ঘটছিল। এ সবকিছু ঘটানোর জন্য কেউ কোথাও থেকে পরিকল্পনা করেনি। এ রকম কিছু ঘটেনি।’
ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ
নিক ক্লার্ক বলেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সংখ্যালঘুর অধিকার প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করার পরিকল্পনা তার।
জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সংখ্যালঘুদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, দেখুন, আপনি দেশের নাগরিক। সংবিধান আপনাকে আপনার অধিকার, স্বাধীনতা, নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার, আপনার নিজের ধর্ম পালনের অধিকার দিয়েছে। এগুলো সংবিধানেই আছে।
‘সুতরাং এটি আপনার (বাইরের দেশ) দিক থেকে আসা কিছু নয়। নাগরিকরা সংবিধানের দেয়া অধিকার যাতে ভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করাই সরকার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।’
তখন সঞ্চালক বলেন, হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে বলে যে শোনা যাচ্ছে।
উত্তরে শান্তিতে নোবেল পাওয়া ইউনূস বলেন, ‘সহিংসতা বাড়েনি। আমি বলব সহিংসতা কমেছে। বিপ্লবের সময় থেকেই সহিংসতা শুরু হয়। এই কারণে নয় যে তারা হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, তাদের বেশিরভাগই ছিল আওয়ামী লীগের লোক।’
তার রাজনীতি, তার নির্বাচন
ইউনূসের নির্বাচনে দাঁড়ানোর আগ্রহ আছে কিনা, জানতে চেয়েছিল আলজাজিরা। উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘না, আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি যা করছি তা উপভোগ করছি। আমার জীবন শেষ পর্যায়ে, এখন আমার (ভূমিকা) পরিবর্তন করতে চাচ্ছি না।’