শরীয়তপুর টাইমস্ ডেস্ক ঃ
বিদায় সবসময়ই এক বিষণ্নতা বয়ে আনে, তবে কিছু বিদায় থেকে যায় হৃদয়ের গভীরে, হয়ে ওঠে চিরস্মরণীয়। এমনই এক বিদায়ী সংবর্ধনা পেয়েছেন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার দক্ষিন দড়িকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী মো: খলিলুর রহমান। এই শিক্ষকের অবসরগ্রহণ উপলক্ষে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বর্ণিল এই আয়োজন করেছে।
ফুলের মালায় সজ্জিত ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়িতে শিক্ষার্থী ও সহকর্মীরা তাকে সুসজ্জিত করে তোলেন। এ আয়োজনটি শুধু একটি বিদায় নয়, ছিল ভালোবাসা, সম্মান আর কৃতজ্ঞতার এক জীবন্ত নিদর্শন। এই ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন যেন বিদায়ী মুহূর্তটিকে রঙিন স্মৃতিতে রূপান্তরিত করে দিলো, শিক্ষক মো. খলিলুর রহমানের কর্মজীবনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক অসাধারণ প্রকাশ।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে উপজেলার পালেরচর ইউনিয়নের দক্ষিন দড়িকান্দি গ্রামে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য মো: চুন্নু মালের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার মোঃ মিনহাজুর রহমান।
বিদায়ী ওই শিক্ষক উপজেলার মূলনা ইউনিয়নের বড় মূলনা তালুকদার কান্দি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার দক্ষিন দড়িকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক ছিলেন।
এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন : বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নুর মোহাম্মদ মাল, মোঃ আলফু দড়ি, মুহাম্মদ আলী দড়ি, মোঃ জসিম মোল্লা, মোঃ দলু মাল, মোঃ বাবুল মাল, মতিউল ইসলাম, মজিদ মাদবর, সাবেক ইউপি মেম্বার আলমগীর মোল্লা, ইউপি মেম্বার হাবিব ঢালী।
আরোও বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন : দক্ষিন দড়িকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকতার উজ্জামান, সাবেক প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ জালাল উদ্দিন, সাবেক প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) ইকবাল হোসেন, সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মিজানুর রহমান, সহকারী শিক্ষক কেয়া সিকদার মীম, সহকারী শিক্ষক রানী আক্তার।
গতকাল মঙ্গলবার প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমানের চাকরিজীবনের শেষ দিন ছিল। ওই দিন এভাবেই তাকে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।
বিদায়ী মুহূর্তে আবেগাপ্লুত হয়ে শিক্ষক মো. খলিলুর রহমান তাঁর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন : "আমি আজ বিদায় নিচ্ছি, তবে রেখে যাচ্ছি আমার ভালোবাসা আর অগাধ দোয়া। তোমরা একদিন বড় হয়ে উঠবে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন আমাদের এই দিনগুলো, এই ভালোবাসার সম্পর্ক নিশ্চয়ই মনে পড়বে। সব সময় চেষ্টা করবে নিজেকে একজন সৎ, মানবিক ও ন্যায়বান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। তোমরা যে সম্মান আর ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বিদায় জানিয়েছ, তা আমার হৃদয়ে চিরকাল গেঁথে থাকবে। এই স্মৃতি আমি আজীবন বয়ে বেড়াব। আমি মাঝেমধ্যে এই প্রিয় বিদ্যালয়ে ফিরে আসব, তোমাদের খোঁজ নিতে, তোমাদের সাফল্য দেখে গর্বিত হতে। তোমাদের জন্যই আমার প্রার্থনা নিরন্তর।"
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মৌমিতা শেখ বলেন : খলিলুর রহমান স্যার শুধু শিক্ষক ছিলেন না, তিনি বাবার মতো আমাদের স্নেহ করতেন। তার বিদায় আমাকে খুব মর্মাহত করছে। তিনি না থাকলেও তার দেওয়া শিক্ষা আমাদের মানবিক জীবন গড়তে সহায়ক হবে।
সহকারী শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন : বিদায়ী শিক্ষক খলিলুর রহমান শুধু একজন শিক্ষক নন, তিনি আমার ভাইয়ের মতো ছিলেন। যেকোনো বিষয়ে পরামর্শ নিতাম। বিদায় বড় কষ্টের, তবুও মানতে হবে। আমাকেও এভাবে একদিন বিদায় নিতে হবে। একজন শিক্ষকের বিদায়কে স্মরণীয় করে রাখতে তাকে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্মরণে রাখতেই এমন ব্যতিক্রমী ও বর্ণাঢ্য আয়োজন।
জাজিরা উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো: নেয়ামত হোসেন বলেন : “একজন শিক্ষক যখন তাঁর কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে অবসর গ্রহণ করে বাড়ি ফিরে যান, তখন তা তাঁর জন্য এক আবেগঘন ও কষ্টের মুহূর্ত হয়ে ওঠে। সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের ছেড়ে যাওয়া সত্যিই বেদনাদায়ক। সেই বিদায়ের বেদনা কিছুটা হলেও লাঘব করার উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ ব্যতিক্রমী এই আয়োজন করেছে। জাজিরায় এই প্রথমবারের মতো এমন উৎসবমুখর পরিবেশে কোনো শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলো। শুধু খলিলুর রহমান স্যার নন, প্রতিটি শিক্ষকই এমন ভালোবাসা ও সম্মান পাওয়ার যোগ্য। তাঁদের প্রত্যেকের বিদায়ই হওয়া উচিত এমন উৎসবমুখর ও মর্যাদাপূর্ণভাবে।”
জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী রায় বলেন : “আজকের এই বিদায়ী সংবর্ধনা শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, একজন শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকাশ। ঘোড়ার গাড়িতে এমন আয়োজন আমাদের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমি আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই এবং বিদায়ী শিক্ষককে আন্তরিক শুভকামনা জানাই।”